মাঝপথে সবার আগে রবিউল
একটা
মানুষকে কতটা শাসন করলে তাকে শাসন করা বলবে, ঠিক তার চেয়েও বেশি শাসন একজন মানুষকে
করতাম। জীবনে যার সাথে ভালো করে যৌথ ছবিও তেমন একটা তোলা হয়নি। সেও আমাকে কখনো
বলেনি “ভাই আসেন একটা ছবি তুলি”। কেন করেনি? একথা আমার কাছের কাউকে জিজ্ঞেস করলেই
বলবে, “ও সম্ভবত আপনাকে ভয় পেত”। হ্যাঁ আমার ধারণা সম্ভবত তা-ই বলবে।
যাক
সে কথা। শুরুর কথা বলি। হেলাল। আমরা একসাথেই মাদ্রাসা ও পলিটেকনিকে পড়েছি। এরই
সাথে একই এলাকার এবং একই আন্দোলনের ছায়া তলে কাজ করেছি। একদিন আছরের নামাজের সময়
আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাড়ার কিছু ছেলেপেলেকে সাথে করে নিয়ে আসল। এর ভেতরে লম্বা করে
একটি ছেলে। কয়েকজনের মধ্যে ও-ই একটু বেশি সুদর্শন । অর নাম রাসেল। আরেকটি
ছেলে আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে নাজমুল। কিছুটা ফটকা
টাইপের। মামাতো
ভাইয়ের ছেলে হলেও, একথা সবার জানা দরকার। বাড়ির পশ্চিমপাড়াকে বলা যায় আমরা অন্ধকার
বা অবহেলিত পাড়া হিসেবেই ধরতাম। বিধায় অই পাড়ার ছেলেপেলেদের সাথে আমাদের পাড়ার
ছেলেপেলেরা চলত না। তারই ধারাবাহিকতাই আমিও চলতাম না। তাই নাজমুল সম্পর্কে ভাতিজা
হলেও বয়সে ছোট এবং পশ্চিমপাড়ার হওয়ায় তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। আরেকটি ছেলেকে
কেমন জানি ভারত্বপূর্ণ মনে হল। বেশি কথা বলছে না। চুপচাপ। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই
কেবল জবাব দিচ্ছে। ওর নাম রবিউল। নাজমুল যেখানে অতিরিক্ত কথা বলে বিরক্ত করছে,
সেখানেই রবিউল থামানোর চেষ্টা করছে। সেই কারণেই রবিউলকে সেদিন থেকে
আলাদা দৃষ্টিতে দেখা শুরু করি। তবে রাসেলকে আমি একটু বেশিই গুরুত্ব দিতাম। বয়সে বড়
লম্বা চওড়া আর সুদর্শন হওয়ায়। সাথে আরো কিছু ছেলেপেলে ছিল। কিন্তু বিষয়বস্তুর
বাহিরে চলে যায় বিধায় তাদের কথা বাদ দিলাম। এইকয়েকজনকে আগে থেকেও
মোটামুটি চিনতাম। কিন্তু সামনা সামনি আজকেই পরিচয় করিয়ে দিল হেলাল। আমি বেশ খুশি,
কারণ নতুন ছেলেপেলে পেলেই কাজের পরিধি বেড়ে যায়। আমাদের সঙ্গিসাথীও বাড়ে।
ওদেরকে মসজিদে নিয়ে আসার অভিপ্রায় ছিল কুরআন শিখানো। বেশ কয়েকজন জুটে
যাওয়ায় হেলাল বেশ ভালোভাবেই ওদের কুরআন শেখানো শুরু করে।
তখন পর্যন্ত আমাদের মসজিদে কোনো মক্তব ছিল না। ছিল না কুরআন শেখার
অন্যকোনো মাধ্যম। তবে আমার বড়ভাই মাওলানা আবু সাঈদ ছাত্রজীবনে বেশ কিছুদিন বড়দের
কুরআন শিখিয়েছেন। তবে তার দৈর্ঘ্য খুব কমই ছিল। তবে আমার এবং আমাদের ক্লাব মাসুর
(মানব সেবা ও উন্নয়ন) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটা মক্তব প্রতিষ্ঠিত করেছি ৮ বছর
হয়ে গেছে।
বলছিলাম রবিউলের কথা। কম বয়সেই এইরকম ভারত্বপূর্ণ ছেলে এরপূর্বে আমি
আর দেখিনি। ও খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারত। তবে আমি শুনিনি। অন্য সবাই এবং রবিউল
নিজেই বলেছে। নাজমুল আর রবিউলের ছিল গলায় গলায় ভাব। সারাদিন বাঁশের আড়ার মধ্যে
ঘুরে বেড়াতো আর এটা অটা দিয়ে বাঁশি বাজাতো। এইতো গতবছর বাড়ি ফিরে রাতে রবিউলের
সাথে রিহার্সেলের সময় কথা হচ্ছিল। ও বলল- ভাই, একদিন তো বাগবাটি মেলায় গেছিলাম।
বাঁশির দোকানে বাঁশি দেখতেছিলাম। একসময় আমি একটা বাঁশি নিয়ে বাজানো শুরু করলাম।
তখন দোকানদার আমাকে বলল, “গ্যাদা তুমি আমার এইখানে থাকো। বাঁশি দিমু নি। তুমি
খালি, এল্লা বাঁশি বাজাইবা”।
এ গল্প
একজন বংশীবাদক থেকে একজন ইসলামী গানের শিল্পী হয়ে যাওয়ার গল্প। কয়েক পৃষ্ঠার ইসলামী সাহিত্য যে মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে,
তার জ্বলন্ত প্রমাণ আন্দোলনের নেবেদিতপ্রাণ মানুষগুলো। যার সবচেয়ে পছন্দের কাজই
ছিল বাঁশি বাজানো। সেই ছেলে কিনা, বাঁশি বাজানো ছেড়ে দিয়েছে দ্বীনের কারণে। আমরা
যখন ইসলামী গানে মিউজিক দেওয়া যাবে বা যাবে না তর্কে লিপ্ত। ঠিক তখন রবিউল মাঝে
মাঝেই আমাকে বলত- “ভাই মিউজিক দিয়ে গানগুলোতে প্রাণ নেই। এগুলো শুনতে আমার ভালো
লাগে না”। তখন অনুভব করে ছিলাম। একজন প্রাক্তন মিউজিসিয়ানের
মুখ দিয়ে কী করে এই কথা বের হয়। যার সবচেয়ে প্রিয় ছিল বাঁশি!
অনেকদিন
পর বাড়ি ফিরেছি। সাবেক সহযোদ্ধা হুসাইন মুহাম্মাদ সোহাগ ভাইও বাড়ি এসেছে। দুইজনে
মিলে ঠিক করলাম ভেওয়ামারা যাবো। ভেওয়ামারা বাজারের কাছেই, ইউনিয়ন আমিরের বাড়ি।
সকাল সকাল পায়ে হেটে প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার পথ গেলাম এবং পায়ে হেটেই ফিরে আসছিলাম।
সবুজ মাঠ। চারিদিকে কুইশাল (আঁখ) আর সোনালী ধান। মাঝে মাঝে পাটের ছোট ছোট পোকাগুলো
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুবলা ঘাসের সাথে। এর মধ্যে দিয়ে আমরা আসছি। সোহাগ ভাইয়ের আবার
গলা ভালো। বেশ ভালোই গাইতে পারেন। হঠাত গুন গুন করে গান গাওয়া শুরু করলেন। “জেলে
ভরে জুলুম করে এমন ভাঙ্গা যাবে না” আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। আমার ভাঙ্গা গলা বরাবরই।
তবুও তার সাথে একটু গলা মেলানো চেষ্টা করলাম, যদিও হয়নি। বরং কোরাসে গানের মানহানি
হয়েছে। সেইদিন সোহাগ ভাইয়ের গান শুনে আমার মনে হয়েছিল, আমার এলাকার ছেলেপেলেরাও যদি
সোহাগ ভাইয়ের মত গান গাইতে পারত। সেই থেকেই চিন্তাটা মাথায় ঘুর ঘুর করতে ছিল। হঠাত
আবার চাকুরী ছেলে কিছুদিনের জন্যে গ্রামে চলে আসি। প্রায় ৩ মাসের মত গ্রামে ছিলাম।
তখন সিরাজগঞ্জের সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যতিক্রম সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের কার্যক্রম
তেমন একটা নেই বললেই চলে। তাই ব্যতিক্রম নিয়ে কিছু করার বা ভাবার সুযোগ কোনোটাই
আমার ছিল না। কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমি তো সাবেক। সেই সময় রবিউলের সাথে আমার
বেশ কিছু সময় কেটেছে। তখনই রবিউলকে পরিচালক করে প্রতিষ্ঠিত করি ব্যবধান
শিল্পীগোষ্ঠী। সময়কাল- ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ। রিহার্সেলের জায়গাছিল না।
মাঠেঘাটে প্রোগ্রাম হত। সেইসময়ের কিছু রিহার্সেলের ছবি সংযুক্ত করে দিলাম। একা
একটি মানুষ তুলে এনেছে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমিতো এলাকায় থাকিনি। ও একাই আমার
ব্যবধানকে নিয়ে এসেছে আজকের ব্যবধান শিল্পীগোষ্ঠী।
ফোন
বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রবিউল ফোন করেছে। রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবেই কথা
বলছি। হঠাত খেয়াল করলাম রবিউল গম্ভীর। ও বলছে, “ভাই কয়েকদিন আগে তো সদস্যপ্রার্থী
কন্ট্রাক্ট ছিল। কিন্তু পারিবারিক কাজের জন্য যেতে পারিনি। শহর সভাপতি অনেক বকা
দিছে। আসলে আমার কিছু করার ছিল
না। এর আগের দিনেও সারাদিন শহরে ছিলাম। ওইদিনও যদি বাড়ি থেকে বের হতাম, তবে বাড়ির প্রতি জুলুম হয়ে যেত”। কিন্তু রবিউলের সাথে ওর সেক্রেটারী রবিউল মানে আরেক রবিউল সদস্য হয়ে
যায়। রবিউলকে কেউ বোকা দিল চুপ করে থাকত। কোনো জবাব দিত না।
মাঝে
মাঝেই বায়না ধরত, ভাই আমাদের ব্যবধানের কিছু গান বড় বড় সুরকারকে দিয়ে করে দেন না!
নাম জিজ্ঞেস করতেই- লিটন হাফিজ, আবুল আলা মাছুম ভাইয়ের নাম বলত। আমি বলতাম,ধৈর্য
ধর, সবার গানই দেব ইনশাল্লাহ। কিন্তু এই সবার গান দেওয়ার মত সময় রবিউল আর আমাকে
দেয় নি। মহান আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন কবরদেশের বাড়িতে।
ব্যবধানের
কাজের পরিবর্তে আমি কিছুদিন ব্যতিক্রমের কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পরি। তখন
মাঝেমাঝে বলত ভাই ব্যবধানের রেকর্ডিং করব। ব্যতিক্রম বাদ দেন। আমাদের গান নাই কিছু
নাই। সেই থেকে গান সংগ্রহ শুরু করি। গান আছে, কিন্তু সুর নেই। কী করা যায়। কাকে
দিয়ে সুর করাবো? লোক নাই। কারণ তেমন কোনো সুরকার আমার পরিচিত ছিল না। শেষে আমি
নিজেই কয়েকটা গানের কোনোরকম গাওয়া যায় এইরকম সুর করলাম। এতো তাড়াহুড়ো করে যে গানের
কাজ হয়, সেটা তখন আমাদের দেখেই হয়তো বোঝা যেতো। বগুড়ায় মাসুদ ভাইয়ের স্টুডিওতে
গিয়ে করে আনলাম কয়েকটা গান। সুর ভালো হয়নি ও সাউন্ডকোয়ালিটিও তেমন একটা ভালো হয়
নি। তাতে কী হয়েছে? তবুও আমরা করবই। এই
হচ্ছে আমাদের ইচ্ছে। এসএলআর ক্যামেরা দিয়ে পরের দিনই শুটিং। রবিউলের মেকআপ নিয়ে তো
আরেকটা ঘটনা আছে। আমি আসলে মেকআপ ভালো করে দিতে পারি না।একদিন অকে মেকআপ দিয়ে দেই।
একটু বেশিই হয়েছিল মেকআপ। এখন বাড়িতে মেকআপ দিয়েছি। শুটিং স্পটে যেতে হবে। কিন্তু
এইরকম মেকআপওয়ালা মুখ নিয়ে ওর যেতে লজ্জা হচ্ছিল। তাই একটি গামছা দিয়ে মুখ ডেকে
নিয়ে তারপর শুটিং স্পটে যায়। সেইদিন শুটিং করেছিলাম “যতবার পাপ করি ততবার ক্ষমা
চাই” কেন জানি এইগানটার প্রতি ওর ভালোবাসা একটু বেশিই ছিল।অনেকবার আমাকে বলেছে ভাই
গানটা রেকর্ড করি, রেকর্ড করি। না শেষ পর্যন্ত রেকর্ড আর করা হয় নি। মোবাইল রেকর্ড
দিয়ে গানটা করেছিলাম।
২০১৮ এর
শুরুর দিকে রবিউলকে ব্যতিক্রমের পরিচালক করা হয়। কয়েকদিন পরপরই রবিউলের সাথে
ম্যাসেঞ্জারের কথা বলতাম পরামর্শ দিতাম। ও কাজও শুরু করেছিল। ২৬মার্চ আমাদের
মসজিদে শহরের প্রোগ্রাম ছিল। সদস্য হওয়ার পর। এই প্রথম রবিউলের কোনো প্রোগ্রামে
অংশগ্রহণ ছিল। প্রোগ্রামে রবিউল সাইফুল্লাহ মানছুর ভাইয়ের একটি গান গেয়েছিল- “কী
নিয়ে দাঁড়াবো আমি ও গো প্রভু দয়াময়, শূন্য এ অধমের পুণ্যের সঞ্চয়”। আমার মা বলেছেন, সেদিন রবিউল কিছুক্ষণের জন্য আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল।
মা বলেছিল- “এই রবিউল তোমাক তো আর দেহি না, তুমি তো তেমন একটা আইস না। কই থাকো?”
“চাচি বইলেন না, আমাক তো শহরে দায়িত্ব দিছে সেইজন্যে শহরেই তো থাকা লাগে”। মা
বলেছে- রবিউল এই কী যেন খাতা নিয়া গেলো আর আমি দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম বেশ
কিছুক্ষণ।
মসজিদের
প্রোগ্রাম শেষ। যেতে হবে শহরে। সেইখানে স্টাডি সার্কেল হবে। দুই রবিউল একসাথে
সিএনজির সামনের দিকে দুইসাইটে বসে যাচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক পার হয়ে ফকিরতলা
বাজার। সিএনজির সামনে হঠাত করে একটি সাইকেলচালক বালক চলে আসে। তখন সিএনজী সাইড
করার চেষ্টা করলে উলটে যায়। রবিউলের সাইট নিজে পরে। একটা দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানের
সাথে পর তলপেটে আঘাত লাগে। সাথে সাথেই অকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এলাকায় কোনো
দুর্ঘটনা ঘটলে, আমার মা প্রথমে আমাকে ফোন দেয়। সেদিনও মা সবার আগে ফোন দিয়েছে। যে
রবিউলরা এক্সিডেন্ট করেছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম। রবিউলের অবস্থা খুবই খারাপ।
অপারেশন করা লাগতে পারে। এরই মধ্যেই একদিন পার হয়ে যায়। পরের দিন রাতেই অকে ঢাকা
নিয়ে আসা হয়। আমি বিকেলবেলা রবিউলকে দেখতে যাই ঢাকা মেডিক্যালে। ইমার্জেন্সির গেটে
গিয়ে দেখি, অনেক মানুষ কান্নাকাটি করছে। একেকজনের কেউ না কেউ মারা গেছে। লাশ বের
করে দিচ্ছে। কারো লাশ আবার এম্বুলেন্সে উঠাচ্ছে। তখনই আমার মনের মধ্যে একটা খটকা
দিয়েছে। এইখান দিয়ে যারা ডোকে তারা আর জীবিত বের হয় না। গিয়ে দেখি অপারেশন শেষ।
এখন বের করে দেবে। পকেট থেকে দুইশ না তিনশ টাকা বকশিশ দিয়ে রবিউলকে অপারেশন
থিয়েটার থেকে বের করলাম। কিন্তু রবিউলের চেহারা দেখেই মনে খারাপ হয়ে গেল। কেন যেন
মনে হল ওর অবস্থা ভালো না। আমার আগেই রাসেল এসেছে। রাসেলকে চলে যাওয়ার সময়
বলেছিলাম। যেকোনো অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। যে কোনো কিছুই ঘটতে
পারে। প্রথমে রবিউলকে নেওয়া হল আইআইসিইউতে পর্যবেক্ষণের জন্য। ওখান থেকে বের হয়ে
ডাক্তারের খোঁজ করতে লাগলাম। ডাক্তার বলল- কন্ডিশন কী সেটাতো দেখতেই পাচ্ছেন।
তারপরও আমি জোর করলে বললেন- “লিভারে সমস্যা হয়েছিল। সারা পেটে পায়াখানা দিয়ে মেখে
গেছে। ইনফেকশন হয়েছে। বলেন এটা কী পরিস্কার করা যায়? বাঁচার সম্ভাবনা না-ই বললে
চলে। এখন দোয়া করেন”।
মন আরো
খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর রবিউলের অবস্থা আরো খারাপ দেখে অকে আইসিইউতে
স্থানান্তর করা হল। হাফিজ ভাই আর আতিক ভাই ছিলেন ক্লান্তহীন। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি।
এখান থেকে অখানে। রক্তের কোনো সম্পর্কের ভাই নয়। একমাত্র সম্পর্ক দ্বীন। আপন
ভাইয়ের চেয়েও যেন অনেক কিছু। তাদের দৌড়াদৌড়ি এটাই মনে করিয়ে দেয়। এবার বাসায় ফিরতে
হবে। সকাল হলেই অফিস আছে। রিক্সায় করে গুলিস্থান ফিরছিলাম। ফেরার পথে সবাই কে ফোন
দিচ্ছিলাম, মালেক ভাই, বাবু ভাই, মা, আনান আরো অনেকের কাছেই। শুধু বলছিলাম। রবিউলের অবস্থা ভালো না একটু দোয়া করেন ভাই, মা
একটু দোয়া কর। না, কেউ যেন বিশ্বাস করছে না যে, রবিউলের অবস্থা আসলেই খারাপ। করলেও
মুখে মুখে। কিন্তু আমার যে মনে হয়েছে, রবিউল আর বেশিক্ষণ বাজবে না।
পরের
দিন ২৯ মার্চ। ভোরবেলায় ডিউটি নিয়েছি। যেন দুপুরের মধ্যেই রবিউলের অইখানে যেতে
পারি। ডিউটি শেষ করে ছুটলাম রবিউলের অইখানে। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি। আমার মনে হয়েছে,
রবিউল বাঁচবে না। হয়তো আজকেই বাড়ি যেতে হবে। তিনটার একটু আগে হাসপাতালে গেলাম।
দেখি হাফিজ ভাই ঘুমাচ্ছেন। সারারাত তো এখানে অখানে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তাই হয়তো এই
তিনটার দিকে ঘুমাচ্ছেন। রবিউলের মা এই
মাত্র আইসিইউত থেকে বের হলেন। এসে বলতেছেন। গ্যাদার বুক জানে কেমন খুব তাড়াতাড়ি
ধরফর করতেছে। আমি বললাম, চাচি এ কিছু না। হয়তো সুস্থ হচ্ছে। এর দশ মিনিট পরেই আবার
ডাক পড়ল। আমি ছুটে গেলাম। ডাক্তারের সাথে কথা না বলে, রবিউলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
পালস নেই। অসিলস্কপ কোনো সিগন্যাল দিচ্ছে না আর। ডাক্তার কোথায় জানতে চাইলেই নার্স
একজনকে দেখিয়ে দিলেন।
ডাক্তার
বলছেন- “আমরা তো আগেই বলেছি, রুগীর অবস্থা ভালো না। এখন সর্বশেষ আমরা একটা চেকাপ করে দিয়ে দিচ্ছে, আপনারা নিয়ে যান”।
বেড়িয়ে
এলাম আইসিইউতে। এখন কাকে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওর মা জিজ্ঞেস করতেই বললাম, না
চাচি এমনই ডাকছিল। হাফিজ ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ওর মা ভায়ের থেকে একটু দূরে
নেওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলাম। অবস্থা দেখে এখন কী সিদ্ধান্ত নেবো মাথায়
আসছিল না। ওর মাকে কী বলে নিয়ে যাব। একবার ভাবলাম ওর মাকে আগেই পাঠিয়ে দেই। পরে
সেটাতে আর সায় আসল না। রবিউলের দেহাবশেষের ছাড়পত্র নিতে ৯-১০টা বেজে গেল। সবচে’
বেশি খারাপ লেগেছে মর্গে থেকে ওর লাশ বুঝে নিতে। সেখানে কর্তব্যরত এককর্মী লাশ
বুঝে নিতেও বকশিশ চাইছিল। ওর কথা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে একশটাকা বের করে দিলাম।
কিছু আর বলার ভাষা ছিল না। এমন দেশে আমরা বাস করি, যেতে মর্গে থেকে ভাইয়ের লাশ
বুঝে নিতেও বকশিশ দিতে হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সিরাজগঞ্জের এক পুলিশ অফিসারের
সহযোগিতায় এরপরও বলা যায় খুব দ্রুতই হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে সিরাজগঞ্জের
পথ ধরলাম।
ফজরের
ঠিক শেষ ওয়াক্তে ছোনগাছা মাদ্রাসায় এ্যাম্বুলেন্স থামল। দৌড়ে অজু করে নামাজের জন্য
গেলাম। দেখলাম আনানসহ কারাকারা যেন নামাজ শেষ করছে। আমি গিয়ে ফরজ নামাজ পড়লাম। এতক্ষণ
পর্যন্ত আমিই শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নামাজে দাঁড়িয়ে কেন যেন আর পারছি
না। চোখ দিয়ে একাই পানি পড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারছি না। সবাই লাশ নিয়ে
রবিউলদের বাড়ি চলে গেছে। আমি একাএকা আসছি। বাড়ির সামনে গিয়ে আর যেন পারছি না।
অনেকক্ষণ বাড়ির সামনের পালানের অখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে তখন
স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতাম।
সকাল
দশটায় জানাজা নামাজ। সারা জেলা থেকে লোক এসেছে। সবাই কাঁদছে। আমার এলাকাবাসী হয়ত
ইতিপূর্বে এমন দৃশ্য কখনো দেখে নি। এতোগুলো মানুষ। এই ছোট একটা ছেলের জানাজায়?
ইসলাম মানুষের কী সম্মান দিয়েছে। দ্বীনি আন্দোলনের আখেরাতের পাওয়া তো রয়েছে-ই
দুনিয়াতেও রয়েছে তাদের জন্য সম্মান এবং মর্যাদা। রবিউলের জানাজায় এত মানুষের ঢল
এটাই প্রমাণ করে। যদিও দুনিয়ার সম্মানের জন্য এই আন্দোলন নয়। যেই রবিউলকে কেউ
চিন্ত না। জানত না। আর সেই রবিউলের জন্য সোহেল ভাইয়েরা কান্না করছে!
এর
একদিন পর, আমার বাল্যবন্ধু আবদুর রহিমের বাবার সাথে দেখা। উনি বললেন, আমার চোখ
দিয়ে কখনোই তেমন পানি আসে নি। আর এই রবিউল ছেলেটা মারা গেলো। ওর জানাজায় আমার চোখ
দিয়ে পানি পড়েছে। অতচ আব্বা মা মারা গেছে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে নি। এই রবিউলকে
আমি তো তেমন একটা চিনিও না। আর আমার চোখে ওর জন্য পানি পরে। অবশ্যই রবিউল ভালো ছিল
আর আল্লাহ ওকে ভালো রাখবেন।
রবিউলকে হারানোই এখন পর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে
বেদনাবিদুর ঘটনা। যা আচমকা আমাদের উপর আপতিত হয়েছিল। শহীদি গান রবিউলের খুব
পছন্দনীয় ছিল। আল্লাহ হয়ত, ওর এই চাওয়াকেই ভালোবেসে নিয়ে গেছেন। আমার”। মাঝ পথে থেমে গিয়ে সবার আগে জান্নাতের পথে
রবিউল। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, শহীদি মর্যাদা প্রাপ্য হোক রবিউলের। জান্নাতে আবার
আমরা যেন একসাথে থাকতে পারি। আবার জান্নাতের কোন এক বাগিচায় কোনো এক মুহুর্তে বসবে
গানের আসর। “ঈমানের পথে অবিচল থেকে আমার মরণ যেন হয়, তোমারই কাছে মিনতি আমার"।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন